প্রতিযোগিতার নাম বদলে ‘প্রিমিয়ার লীগ’ রাখার পর যেন বদলে গেল লিভারপুল। দারুণ সফল দলটি দেখল মুদ্রার উল্টো পিঠ। এক দশকে ছয়বার, দেড় যুগে ১১ বার শীর্ষ লীগের শিরোপা জেতা দলটি যেন হয়ে উঠেছিল চ্যাম্পিয়নের প্রতিশব্দ। ট্রফি কেসে ১৮ শিরোপা সাজিয়ে ইংলিশ লীগের সেই সময়ের দলটির হতাশাময় পথ চলার শুরু ১৯৯০-৯১ মৌসুম দিয়ে। এরপর এক না দুই না পরবর্তী লীগ শিরোপা জিততে অলরেডদের সময় লাগে তিন দশক।

লিভারপুলের সাবেক কোচ ফুটবল দার্শনিক বিল শ্যাঙ্কলি একবার বলেছিলেন, “কিছু মানুষ বিশ্বাস করে, ফুটবল শুধুই জীবন-মরণের ব্যাপার। তাদের অমন আচরণে আমি খুব হতাশ। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ফুটবল তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
হয়তো কোচের এই কথাটাই সবচেয়ে বেশি বেশি ধারণ করতে পেরেছিল লিভারপুল। তাই পাহাড়সম সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ঠিকই লিভারপুল ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আরেকবার। হতাশার কালো মেঘ ফুড় উঁকি দিয়েছিল সূর্য। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা। কিন্তু, যে দলের মন্ত্র ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ তারা কি খুব সহজে হেরে যাবে? মৌসুমের সিংহভাগ সময় ইনভিনসিবল শিরোপা জয়ের আশংকা দেখিয়ে লিভারপুল ত্রিশ বছরের আক্ষেপ গুছালো বীরের মত করে।

সেই লিভারপুল বড্ড অচেনা চলতি মৌসুমে। মৌসুমের শুরুর দিকে ইঞ্জুরির কারণে দলের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু খেলোয়াড় নিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কোচ ইয়ুর্গন ক্লপ। সাফল্যও পাচ্ছিলো বটে! তবে দিন যত যাচ্ছে অলরেডরা ফিট একাদশের অভাব যেন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। গতকাল (শুক্রবার রাত) বার্নলির বিপক্ষে যেন তা স্পষ্ট হল আরেকবার।
আক্ষেপ ঘুচানোর বছরে প্রথম ১৮ ম্যাচে অলরেডরা যেখানে পয়েন্ট আদায় করেছিল ৫৫; চলতি মৌসুমে তা মাত্র ৩৪। গেল বছর লিভারপুল প্রথম আঠারো ম্যাচে জয় পেয়েছিল ১৮টি। কোন ম্যাচ না হেরে ড্র করেছিল মাত্র ১টি। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে ম্যাচ জিতেছে মাত্র ৯টি। ৭টি ম্যাচ ড্র করলেও ইতিমধ্যে ম্যাচ হেরে বসেছে ৩টি। যা ২০১৯-২০ পুরো মৌসুমের ৩ হারের সমান। সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচে কোন জয় নেই। গেল ম্যাচে পুঁচকে বার্নলির বিপক্ষে হেরে ৩ বছর ২৭৩ দিন সবমিলিয়ে ১৩৬৯ দিন ৬৮ ম্যাচ পর প্রিমিয়ার লীগে হারের তিক্ত স্বাদও নিতে হয় ক্লপের শিষ্যদের।
অবশ্য তার জন্য অনেকটাই দায়ী লিভারপুলের আক্রমণভাগ। গেল ম্যাচে ৪২তম মিনিটের কথা, বার্নলির ডিফেন্ডার বেন মির ভুলে মাঝমাঠের কাছে বল পেয়েছিল ওরিগি। সেখান থেকে দৌড়ে বার্নলির ডি বক্সেও ডুকে পড়েছিল বেলজিয়াম ফরোয়ার্ড। কিন্তু, ডি বক্সে গোলরক্ষককে ওয়ন টু ওয়ান পজিশনে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয় প্রতিভাবান এই স্ট্রাইকার। চলতি মৌসুমে লিভারপুলের গোটা আক্রমণভাগেরই চিত্র এই তথ্যটুকু। ডিবক্সের বাইরে থিয়াগো, রবার্টসন, উইনাল্ডম, শাকিরিরা একের পর এক সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। আর সেগুলোকে একের পর এক নষ্ট করে গেছেন সালাহ, ফিরমিনো ও সাদিও মানেরা। ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে প্রথম ১৮ ম্যাচে লিভারপুলের গোলসংখ্যা ছিল ৪৭টি; এবার ১০ গোল কমে তা ৩৭। গেল মৌসুমে ক্লিনশীট চলতি মৌসুমের সমান ৬টি থাকলেও এবার ৮ গোল বেশি হজম করেছে। বুঝায়ে যাচ্ছে কতটা খারাপ সময় পার করছে মার্সেসাইডের সবার প্রিয় ক্লাবটি।

ইতিহাস বলে হাল ছাড়া পাত্র নয় লিভারপুল। ইস্তাম্বুল ফাইনাল, এফ কাপের ফাইনাল কিংবা তিন দশকের আক্ষেপ লিভারপুল ঘুরে দাড়িয়েছে নিজেদের মত করেই। ঘুরে দাঁড়ানোর এতসব গল্প রচনা করা দলটি এতো সহজে হাল ছাড়বে কেন? ঘুরে দাঁড়ানোর এতসব গল্প রচনা করা দলটি এতো সহজে হাল ছাড়বে কেন?
দার্শনিক বিল শ্যাংকলি বলেছিলেন, “ফুটবল নিরন্তর…এটা নদীর মত চলতেই থাকে।” এবারও সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন কোচ ইয়ুর্গন ক্লপ। তাই বার্নলির বিপক্ষে ম্যাচ হারার পর অলরেড কোচ বলেছেন, “আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। কোন সন্দেহ নাই আমরা ফিরব। বিশ্বাস করেন আমরা ঘুরে ফিরবো।”
লিভারপুল কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে? গর্ডন জেনকিন্স-জয় ব্র্যাথারটনদের মত বিশ্বজুড়ে লাখো-কোটি লিভারপুল সমর্থকদের ত্রিশ বছরের অধরা স্বপ্নের প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা ধরে রাখতে পারবে ? যাদের ধমনিতে আছে “ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন” তাদের জন্য অসম্ভব কিছু না। আপতত জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে প্রিমিয়ার লীগের শেষ অবধি।
লেখাঃ এ এইচ বাদশা।