ইংলিশ ফুটবলে ডার্বির কথা উল্লেখ করলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যানচেস্টার সিটির কথা আসে তাই না? তবে তাদের সাথে আরেকটা ডার্বির কথা ফুটবল প্রেমীদের মাথায় আসে, সেটা হচ্ছে মার্সেসাইড ডার্বি।
মাঠের বাইরের সব ঘটনা, ইতিহাস মিলিয়ে অলরেড-ব্লুজদের দ্বৈরথ মানেই উত্তেজনা ঠাসা সব ম্যাচ, অহমের লড়াই। যার মধ্যেও কয়েকটি ম্যাচ আলাদা হয়ে আছে কোন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের জন্য কিংবা নিতান্তই ম্যাচকে ঘিরে থাকা উত্তেজনার কারণে। প্রায় ছিয়াত্তর বছরেরও বেশি দীর্ঘ এই দ্বৈরথের ইতিহাস থেকে গুটিকয়েক ম্যাচ বের করে আনা অনেক কঠিন কাজই বটে। তারপরও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, স্পোর্ট ম্যাগাজিন, দুই দলের সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের দৃষ্টিতে সেরা ম্যাচগুলো বের করে আনার চেষ্টা করেছি। সবমিলিয়ে ইতিহাসের সেরা পাঁচটি মার্সেসাইড ডার্বির ম্যাচ নিয়েই এবার আলোচনা করব। জেনে রাখা ভালো, এই সেরা পাঁচটি ম্যাচ বেছে নিতে আমাকে অনেকগুলো অসাধারণ ম্যাচও বাদ দিতে হয়েছে।
৫. লিভারপুল ২- ২ এভারটন, ১৯৭৭ এফএ কাপ সেমিফাইনালঃ
মার্সেসাইড ডার্বির ইতিহাসে অন্যতম সেরা কন্ট্রোভার্সি তৈরী করা ম্যাচগুলোর একটি। ২৩ এপ্রিল, ১৯৭৭ সালে ইংল্যান্ডের মেইন রোড স্টোডিয়ামে এফএ কাপের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে মুখোমুখি হয় দুই নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী। অলরেডরা এই সময় ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা সময় পার করছিল। কোচ রবার্ট বব পেইসলির অধীনে লিভারপুল তৎকালীন ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশন লীগ ডমিনেট করে সবেই ইউরোপও সেরা হওয়ার যে পথে এগুচ্ছে। অন্যদিকে এভারটনের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়। মাত্র লীগ কাপের ফাইনালে অ্যাস্টন ভিলার কাছে হেরে শিরোপা হাতছাড়া করে। তাই বলা যায়, ম্যাচে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল লিভারপুলই।

ম্যাচের শুরুও করে লিভারপুল গোল করে- খেলা শুরুর মাত্র দশ মিনিটেই রয় কেনেডির ক্রস থেকে দারুণ এক গোল করে অলরেডদের এগিয়ে দেয় টের ম্যাকডারমট। যদিও এই লিড বেশিক্ষণ ধরেও রাখতে পারে নাই। ৩৩ মিনিটের সময়ই ডাংকান ম্যাককেঞ্জির গোলে সমতায় ফিরে এভারটন। ১-১ গোলে সমতায় প্রথমার্ধ শেষ করে দুই দল। বিরতি থেকে ফিরে ৭৩ মিনিটে জিমি কেইসের গোলে আবারও এগিয়ে যায় লিভারপুল। এবারও বেশি সময় লীডটা ধরে রাখতে পারেনি অলরেডরা। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার মাত্র ৮ মিনিট আগেই ব্রুস রিয়োসের গোলে কামব্যাক করে দ্যা ব্লুজ। দুই দলের সমতায় যখন খেলা শেষ হচ্ছে তখনই এক অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয় স্টোডিয়াম ভর্তি প্রায় ৫২ হাজারের বেশি দর্শক। খেলার একবারে অন্তিম মুহূর্তে গুডলাসের ক্রস থেকে আইরিশ মিডফিল্ডার ব্রায়ন হ্যামিল্টন গোল করলে উল্লাসে মেতে উঠে নীল রংয়ের জার্সী ধারীরা।
কিন্তু, রেফারী ক্লাইভ থমাস অফসাইড রুলে গোলটি বাতিল করে দেন। যদিও হ্যামিলটনের দাবী সে কখনও অফসাইডে ছিল না। খেলা শেষে রিভিউ করেও ঠিকই বুঝা যায়, থমাসের গোলটি বৈধ ছিল। অবশ্য তখন আর করার কিছু ছিল না। ২-২ গোলে সমতায় শেষ হয়ে যায় ম্যাচটি। পরে ২য় লেগে ওয়েম্বলিতে এভারটনকে ৩ -০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে অলরেড। ফাইনালে নর্থ-ওয়েস্ট ডার্বিতে ম্যান ইউনাইটেডর কাছে কাছে ২-১ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় লিভারপুলকে।
যদি সেদিন হ্যামিলটনের গোলটি হয়ে যেত তাহলে ৩-২ গোলে জিতে হয়তো এভারটন ফাইনালে এক পা দিয়ে রাখত। এফএ কাপের ফাইনাল হয়তো এভারটনকেই দেখা যেত। এই ঘটনার জন্য ‘৭৮ এর বিশ্বকাপের সময় রেফারী ক্লাইভ থমাস এক সাক্ষাৎকার এভারটনের দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। নিশ্চিত, এই ম্যাচটি দ্যা ব্লুজরা কখনও ভুলবে না।
৪. এভারটন ১-০ লিভারপুল, ১৯৮৪ ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশন লীগের ২য় লেগ
ইতিমধ্যে লিভারপুল ইউরোপের অন্যতম পরাক্রমশালী ক্লাবগুলোর একটি। প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক ইউরোপসেরা হয়ে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় ক্লাবের তকমা এখন অলরেডদের। বিল শ্যাঙ্কলি এবং বব পেইসলির ক্যারিশমাটিক কোচিংয়ে ইংলিশ ফুটবল একচেটিয়া রাজত্ব করছে। অন্যদিকে এভারটন তুলনা মূলকভাবে ভালো সময় পার করছে। লীগের প্রথম ম্যাচ স্পার্সদের ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে শুরু করে। তবে তার চেয়ে বড় এডভান্টেজ লিভারপুলের ঘরের মাঠে গিয়ে প্রথম লেগে তাদের হারানো। আক্ষরিকার্থে এই সিজন
ছিল এভারটনের কামব্যাক করার মৌসুম। সবমিলিয়ে দারুণ একটি উত্তেজনা ঠাসা ম্যাচ দেখার অপেক্ষায় গুডিসন পার্কে উপস্থিত প্রায় ৫৪ হাজার বেশি দর্শক।

ঘরের মাঠে দর্শক পেয়ে এভারটন শুরু থেকেই একের পর এক আক্রমণে লিভারপুলের ডিফেন্ডারদের দারুণ পরীক্ষা নেয়। শুরু থেকেই ম্যাচের লাগামটা ধরে রাখে এভারটনই। ইউরোপের অন্যতম সেরা দল নিয়েও এই দিন কোন সুবিধা করতে পারেনি লিভারপুল। দিনটা হয় লিভারপুলের ছিলই না! মাঝেমধ্যে কাউন্টার এট্যাকে কিছু সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলেও তা হেলায় হাতছাড়া করে স্ট্রাইকাররা। দুই দলের হার্ড ডিফেন্সের কারণে দুই দলই ডেডলক ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রথমার্ধ শেষ হয় গোল শূন্য স্কোরে।
দ্বিতীয়ার্ধে লিভারপুল নিজেদের মেলে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু, তা বদলে যাওয়া এভারটনকে পরীক্ষায় করার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না। উল্টো খেলার যখন শেষ মুহূর্ত, হ্যাঁ সবাই যখন শূন্য গোলের সমতায় ম্যাচটার শেষ দেখতে পায় তখনই লিভারপুলের অর্ধে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে
অসাধারণ এক ভলিতে গোল করে সবাইকে চমকে দেয় ইংলিশ মিডফিল্ডার গ্রায়েম শার্পস। উল্লাসে মেতে উঠে ব্লুজরা ! গোলটি অনেকের মতে, ইংলিশ ফুটবল হিস্ট্রির অন্যতম সেরা গোলগুলোর একটি। প্রায় ২ লক্ষ ভোটে গোলটি ১৯৮৪ সালে ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশনের সেরা গোল নির্বাচিত হয়। শার্পের একমাত্র গোলে লিভারপুল দারুণ একটি দল নিয়েও এভারটনের কাছে দুই লেগই হারার লজ্জা পায়। যদিও এই হার লিভারপুলের লীগ টাইটেল জয়ে খুব বেশি প্রভাবও ফেলতে পারেনি। এই ম্যাচের পরের উইকেন্ডে এভারটন ম্যান ইউনাইটেডকে ঘরে মাঠে গুডিসন পার্কে ৫-০ গোলে হিউমিলিয়েটেড করে। এসময় এভারটন দলটা এত দারুণ ফুটবল খেলে ইউরোপীয়ান কম্পিটিশনে ইংলিশ ক্লাবগুলো ব্যান না থাকলে একটা ইউরোপীয়ান ট্রফি হলেও ব্লুজদের ট্রফি ক্যাবিনেটে হয়তো যোগ হতে পারত।
৩. এভারটন ২-৩ লিভারপুল, ইংলিশ প্রমিয়ার লীগ ‘০১
২০০১ সাল। ক্রীড়া দুনিয়ার সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী ঘটনা প্যাট র্যাফটার কে হারিয়ে ক্রোয়েশিয়ান টেনিস তারকা গোরান ইভানিশেভিচ ইতিহাসে প্রথম ওয়াইল্ড কার্ডধারী হিসেবে গ্রান্ডস্ল্যাম জয় করে; তাও টেনিসের অলিম্পিক খ্যাত উইম্বলডন। বরিস বেকার এরপর তিনিই প্রথম অবাছাই হিসেবে গ্রান্ডস্ল্যাম জয় করেন। ইংল্যান্ডে যখন উইম্বলডন গ্রান্ডস্ল্যাম ফাইনালের জন্য প্রস্তুত ঠিক একই দিন সোমবার গুডিসন পার্কে প্রিমিয়ার লীগ মার্সেসাইড ডার্বি অনুষ্ঠিত হয়। উইম্বলডন ফাইনালের জন্য স্বভাবত কেবল মার্সেসাইড শহর ব্যতীত ইংল্যান্ডের অন্য শহরে এই ম্যাচ নিয়ে ফোকাস ছিল কম।

খেলা শুরুর পূর্বেই লিভারপুল ‘The Hillsborough disaster’ এর ১২তম বর্ষপূর্তিতে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। ইঞ্জুরি ধকল কাটিয়ে ম্যাচে ফিরে এভারটন স্কটিশ স্ট্রাইকার ডানকান ফার্গুসন। হঠাৎ মাইকেল ওয়েনকে বেঞ্চে বসিয়ে রবি ফাওলারের এট্যাকিং পার্টনার হিসেবে লিভারপুলের স্টার্টিং লাইন- আপে আসে এমিলি হেস্কি।
কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে হেস্কি সময় নেন মাত্র ৪ মিনিট। স্টেভ ওয়াটসনের ভুলে মাত্র ৪ মিনিটেই দারুণ গোল করে লিভারপুলকে এগিয়ে দেয় এমিলি হেস্কি। পাঁচ মিনিট পর বিপদজনক জায়গায় হ্যান্ডবলের জন্য হলুদ কার্ড দেখে লিভারপুল মিডফিল্ডার ইগর বায়ান। বিরতির আগে অলরেডরা যখন ১-০ গোলের লীড নিয়ে মাঠ ছাড়াবে ঠিক তখনই ফার্গুসনের আচমকা ১৫ মিটার দূর থেকে জোরালো শটে পরাস্ত হন লিভারপুল গোলকিপার ওয়েস্টারভেল্ড।
প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-১ গোল সমতায়। নাটকীয় ম্যাচটির সব রসদ যেন জমা ছিল ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ! ৫৭ মিনিটে হামানের ডিফেন্স ছেড়া একটি দারুণ পাস বল যায় রবি ফাওলারের কাছে। ফাওলারের ক্রস রিকভার করে জেমিল; সেখান থেকে বল পায় মার্কাস বাবেল।
বাবেলের লং রেঞ্জ শটে পরাস্ত হয় জেরার্ড। অলরেডরা এগিয়ে যায় ২-১ গোলে। এতক্ষণ পর্যন্ত ম্যাচের সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু, ১ মিনিট পরই শুরু হয়ে যায় হট্টগোল। রিচার্ড গাফের বিতর্কিত পেনাল্টিতে মাঠেও উত্তেজনা দেখা দেয়।যদিও পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয় রবি ফাওলার। ৭৬ মিনিট দ্বিতীয়বার হলুদ কার্ড খেয়ে মাঠ ছাড়েন লিভারপুলের ইগর বায়ান। দশ জন এর দলে পরিণত অলরেডরা। দশ জনের লিভারপুলকে পেয়ে একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে এভারটন। ৫ মিনিট পর এবার বিতর্কিত পেনাল্টি পায় ব্লুজ। কিন্তু, স্পটকিক থেকে রবি ফাওলারের মত এবার আর ভুল করেনি এভারটনের আন্সওর্থ। ম্যাচও ২-২ সমতায়।
নির্ধারিত সময়ের ৯০ মিনিটে দুই দলের সমতায় থাকার পর রেফারী জেমস উইন্টার লস টাইম হিসেবে সময় দেন ৫ মিনিট। এই অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ প্রান্তে; খেলা শেষ হওয়ার বাকী মাত্র ১ মিনিট। নিজেদের অর্ধে লিভারপুলের সাব হয়ে নামা ভিগনালকে ফাউল করে আলেক্সান্ড্রাসন। ৪৪ মিটার দূরত্ব থেকেই ফ্রিকিক পায় লিভারপুল। ফ্রি-কিক নেন ম্যাকঅ্যালিস্টার। রেফারী উইন্টারও খেলা শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সম্ভবত, ফ্রি-কিকের পরেই খেলা শেষ হওয়ার বাঁশি ফু দিবেন। ম্যাকঅ্যালিস্টার এসে জোরালো শট নিলেন গোল -পোষ্টের বাম দিকে। জেরার্ড শত চেষ্টা করেও তার বুদ্ধিদীপ্ত শট ঠেকাতে ব্যর্থ হোন এবং লিভারপুলের গোললল!!
হ্যাঁ, খেলা শেষ হওয়ার শেষ মুহূর্তেই গুডিসন পার্ক থেকেই ৬৫তম মার্সেসাইড ডার্বি জিতে ঘরে ফেরে লিভারপুল। সেই সাথে অলরেডদের হয়ে নিজের চাকরিও বাচিয়ে নেন ওয়ালটার স্মিথ। একটি ম্যাচ, ৫ গোল, ২ পেনাল্টি, রবি ফাওলার পেনাল্টি মিস, ১টি রেডকার্ড এবং খেলা শেষ হওয়ার শেষ মুহূর্তে ফ্রিকিক থেকে দারুণ গোলে ১০ জনের লিভারপুলের অবিশ্বাস্য জয় সবমিলিয়ে এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে অলরেডদের জন্য।