সাকিব আল হাসান দূরের ওই বিদ্যুৎের খুঁটিটাকে ইশারা করলেন। স্মৃতির দুয়ারে ফিরে গেলেন হারানো দিনে। ভাবনায় হারিয়ে বলতে শুরু করলেন, আহ! কি সময় ছিলো তখন… ওই যে খুটিটা দেখছেন, ওই খুটিটাকে স্ট্যাম্প বানিয়ে কতো খেলেছি। এই যে এই অল্প জায়গাটুকো দেখছেন এইখানেও আমরা খেলেছি, ওই রাস্তাতেও গাড়ি থামিয়ে খেলেছি। ওই যে পুকুরটা দেখছেন, ওটার পাশের ওই খালি জায়গাটাতেও খেলেছি।
জানেন, আজও আমার কিছু শট খেলতে সমস্যা হয় এই মাঠটার কারণে। আরও কিছু মাঠ আছে এর অন্তর্ভুক্ত। এই মাঠগুলোতে খেলতে গিয়ে নানান নিয়মের মাঝে দিয়ে যেতে হতো। কখনো বলা হতো, পুকুরের দিকটায় গেলে আউট, কখনো উড়িয়ে মারলে আউট, কখনো ওই বাসার সীমানায় গেলে আউট। কখনো বা ধান ক্ষেতে গেলে আউট! বলেই সাকিব আল হাসান একরাশ হেসে নিলেন আপনমনে।
এগুলো তো সাকিব নিজেই বলছিলেন। কিন্তু আরও কিছু তথ্য আছে যা আমাদের খুঁজে নিতে হয়েছে। যেমন, আজ থেকে কুঁড়ি বছর আগের কথা। সময়টা তখন ২০০১। হালের সাকিব আল হাসান তখনও ‘ফয়সালে’র অন্তরালে। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া খুবই শান্ত স্বভাবের এক ছেলে। বয়সের তুলনায় একটু যেন বেশিই চাপা স্বভাবের। দুষ্টুমিতে নেই। পড়া-লেখায় তার ধারেকাছেও কেউ নেই। নেই প্রতিবেশীর বাসার গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করার অভিযানে কিংবা বন্ধুদের ঝগড়া-মারামারিতে। পড়ালেখা থেকে তাকে দূরে রাখতে পারতো শুধুই একটা জিনিস। তা হলো ‘ক্রিকেট‚! সেই ছোট্টটি থাকতেই ব্যাট-বলের এই খেলাটার সাথে তার রসায়ন দুর্দান্ত।
এই ভালো লাগা থেকেই এই পাড়ার সঙ্গে ওই পাড়া, বা এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের ম্যাচে একটা দলের হয়ে খেলতে শুরু করলেন একটা সময়। বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা পাওয়া। ছোটবেলায় কখনো এলাচি বিস্কুটের প্যাকেট বাজি ধরে খেলতেন। আবার কখনো বেশি মানুষ হলে এক টাকা দুই টাকা করে বারো টাকা হলে বাটার কুকিজ বিস্কুটকে শিরোপা বানিয়ে খেলতেন। খুব ভালো খেলে বলেই নানা জায়গা থেকে ডাক আসে খেলার।তো এমনই একটা ম্যাচ খেলতে মাগুরা থেকে বাসের ছাদে চেপে এই আলোকদিয়ার মাঠে এসেছিলেন সেদিনর তরুণ ফয়সাল।
সেই ম্যাচে এতোটাই ভালো খেলেছিল, তার খেলা দেখে ম্যাচের আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন (গোর্কি) রীতিমতো মুগ্ধ বনে যান। এই ম্যাচে আম্পায়ার হলেও সাদ্দাম আদতে একজন ক্রিকেটপাগল মানুষ। নিজের একটা দলও আছে তাঁর মাগুরায়। ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব। ফয়সালে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তাঁর দলের হয়ে খেলার জন্য।
প্রস্তাব পেয়ে চলেও গেলেন একদিন ক্লাবে, লিখিয়ে নিলেন তার নামটা। মূলত পেস বোলিং করতেন। সেটিও সত্যিকারের ক্রিকেট বলে নয়, টেপ টেনিসে। সত্যিকারের ক্রিকেট বল তখনো হাত দিয়ে ধরার সৌভাগ্যই হয়নি তার! ইসলামপুরপাড়া ক্লাবের নেটেও ফয়সাল প্রথমে পেস বোলিং করলেন। তবে কোচ সাদ্দামের অভিজ্ঞ চোখ খুঁজে নিলো ভিন্নতা। বুঝলেন ছেলেটার হাতে স্পিনই বেশি কার্যকরী হবে। সুতরাং কোচের যটপট আদেশ, ‘তুমি স্পিনই করো।’
কদিন পরই মাগুরা লিগে অভিষেক হলো ফয়সালের। সত্যিকার ক্রিকেট বলে প্রথমবারের মতো কোনো ম্যাচে বল করা হলো ফয়সালের। এবং কী আশ্চর্যের কথা, ক্রিকেট বলে নিজের প্রথম বলেই উইকেট! অতঃপর? অতঃপর ফয়সাল নামটা ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগলো…, প্রস্ফুটিত হতে লাগলো সাকিব আল হাসান নামের ফুলটা। যেই ফুলের সুবাসে আজ গোটা বিশ্ব মাতাল!