২০১৮ সাল, চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল, কিয়েভ।

পুরো আসর জুড়ে জার্মান মাস্টারমাইন্ড ইয়ুর্গেন ক্লপের গেগেনপ্রেসিং ফুটবলের উপর ভর করে অসাধারণ  ফুটবল খেলে ১৩ বছর পর ফাইনালে উঠে ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুল। সেদিন ফাইনালে অলরেডদের প্রতিপক্ষ আসরের সর্বোচ্চ ১২ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ।

উত্তেজনা ঠাসা ম্যাচে শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদকে কাঁপিয়ে দেয় অলরেড শিবির। স্প্যানিশ দলটির অগোছালো ফুটবলের সুযোগ নিয়ে একের পর এক আক্রমণে করে রক্ষণের কঠিন পরীক্ষা নেয় ক্লপ শিষ্যরা। কোনভাবে লিভারপুলের আক্রমণের ঝাপটে সামলে নেয় মার্সেলো -রামোস- কার্ভাহাল-ভারানেরা। তবে পুরো ম্যাচ জুড়ে অসাধারণ ফুটবল পসরা সাজিয়েও লাভ হয়নি ইয়ুর্গেন ক্লপ বাহিনীর।

জার্মান গোলরক্ষক লরিস কারিয়ুসের কিছু হাস্যকর, শিশুসুলভ এবং অমার্জনীয় ভুলে খুব কাছে গিয়েও রিয়াল মাদ্রিদের কাছে শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয় লিভারপুলের। ম্যাচে কারিয়ুস ঠিক কতটা ভুল করেছিলেন তা বুঝতে গ্যারেথ বেলের শেষ গোল করার পর ধারাভাষ্যকারের মজার এন্ট্রিটা শুনলেই বুঝা যায়। মজার চলে হাসতে হাসতে তিনি তো বলেই ফেললেন, ” উফফফ! কি মজাদার গোল!”

শিরোপা জয়ের এত কাছে এসেও এমন ট্রাজিক বিদায় মেনে নিতে পারেননি কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। ঘটনাবহুল সে ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক সার্জিও রামোসের এক মারাত্মক ট্যাকলে লিভারপুলের মোহাম্মদ সালাহর অশ্রুসিক্ত বিদায় কাঁদিয়েছিল পুরো ফুটবলবিশ্বকে। লিভারপুল ঠিক পরের বছরই নিজেদের গুছিয়ে ইউরোপ সেরা হয়ে সে যন্ত্রণায় কিছুটা প্রলেপ দেয়। সেবার রিয়াল মাদ্রিদকে না পেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ না হলেও এবার ঠিকই সুযোগ এসেছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দলের।

দুই বছর পর ফের মুখোমুখি হচ্ছে দুদল। তবে  ইউরোপ সেরার আসরে এবার ফাইনাল নয়, শেষ আটেই লড়াই করবে দল দুটি। বলা যায়, এবারও চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ আটে সবচেয়ে বড় ম্যাচে লড়াই হবে প্রতিযোগিতার সফলতম দুই দলের।

মৌসুমের শুরুতে উথান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেলেও বর্তমানে দারুণ ছন্দে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। সবশেষ ম্যাচে লা লিগায় এইবারকে হারিয়ে টানা তিন জয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে বেশ সাবলীল জিনেদিন জিদানের দল। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটের পাশাপাশি বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা লা লিগা শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে বার্সেলোনা ও অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে টক্কর দিচ্ছে সমান তালে। যদিও ইউরোপসেরার আসরে মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের অধারাবাহিকতা  কিছুটা চিন্তায় ফেলবে লস ব্লাংকোসদের।

ওদিকে ঠিক বিপরীত অবস্থা লিভারপুলের। চলতি মৌসুমে ইউরোপসেরার আসরে ঠিকঠাক চললেও, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বড্ড অচেনা ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। রিয়াল মাদ্রিদের মতো তারাও গতবারের লিগ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এবার রিয়ালের চেয়ে তাদের অবস্থা তথৈবচ। লিগে ছয় নাম্বারে হাবুডুবু খাচ্ছে অলরেডরা। শীর্ষে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে পয়েন্টের ব্যবধান এখনই ২৫। হাতে আছে আর মাত্র নয়টা ম্যাচ। রিয়ালের যদি লিগ শিরোপা জেতার এখনো সামান্যতম সম্ভাবনাও থেকে থাকে, লিভারপুলের সেটাও নেই। যদিও প্রিমিয়ার লিগের আফসোস চ্যাম্পিয়নস লিগে কিছুটা পুষিয়ে নিচ্ছে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নরা।

ইউরোপসেরার আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডে গতবারের সেমিফাইনালিস্ট জার্মান ক্লাব লেইপজিগকে খুব সহজে হারিয়েছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। লিগে জঘন্য খেলা দলটা চ্যাম্পিয়নস লিগেই যেন নিজেদের খুঁজে পাচ্ছে বারবার। এমনকি গ্রুপ পর্বেও ইতালিয়ান ক্লাব আটালান্তা ও দুই বছর আগের সেমিফাইনালিস্ট আয়াক্সকে হেসেখেলে হারিয়ে এসেছে তাঁরা। যা রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জিনেদিন জিদানের জন্য হতে পারে চিন্তার বড় কারণ। তাছাড়া, সবশেষ ম্যাচে এমিরেটস স্টোডিয়ামে আর্সেনালের বিপক্ষেও বড় জয় দারুণ আত্মবিশ্বাস যোগাবে সফরকারীদের।

আধুনিক ফুটবলে ২০০৯ এর কোয়ার্টার ফাইনালে তারকা ঠাসা রিয়াল মাদ্রিদকে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-০ গোলে বিদায় করে লিভারপুল। ২০১৪-এর গ্রুপ পর্বে দুই ম্যাচই জিতে যার মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল রোনালদো-রামোসরা। ২০১৮ সালে কিয়েভে অলরেডদের কাঁদিয়ে নিজেদের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করে রিয়াল মাদ্রিদ।

ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসরে দুদলের মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রথম তিন ম্যাচ জিতেছিল লিভারপুল। সবশেষ টানা তিন ম্যাচ জিতে সমতায় এনেছে লস ব্লাংকোসরা। চ্যাম্পিয়ন লিগে ঘরের মাঠের প্রথম লেগে সবশেষ ৯ বারের ৮ বারই জয় পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। কেবল গেল মৌসুমেই ঘরের মাঠে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ২-১ গোলে হেরে বসে জিনেদিন জিদানের দল। তাছাড়া চলতি মৌসুমে সবধরনের প্রতিযোগিতায় মিলিয়ে সবশেষ ১১ ম্যাচের ৯টিই জয় পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, যা ঘরের মাঠে বাড়তি অনুপ্রেরণা দিবে ক্রুস, মদ্রিচ ও বেনজেমাদের।

ইঞ্জুরি সমস্যা দুদলের মধ্যেই রয়েছে। মাংসপেশির ইঞ্জুরিতে পড়ে সার্জিও রামোস দলের বাহিরে থাকায় এবার ফুটবল প্রেমিদের বহু আকাংখিত রামোস- সালাহ লড়াই হচ্ছে না। মাদ্রিদ কাপ্তানের অনুপস্থিতিতে লিভারপুলের আক্রমণভাগ কিছুটা চাপমুক্ত থাকবে। রিয়ালের আক্রমণ সামলাতে এই ম্যাচে ক্লপ খেলাতে পারেন ডিফেন্ডার নাথানিয়েল ফিলিপসকে।

 

রিয়াল শিবিরে চোট সারিয়ে ছন্দে ফেরার পরে সাত ম্যাচে ৯ গোল করে ফুটছেন করিম বেনজেমা। ছন্দে রয়েছেন মার্কো অ্যাসেনসিও, ভিনিসিয়াস জুনিয়রেরাও। আর তাঁদের বল জোগানোর জন্য রয়েছেন লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুসরা। বাঁ দিক থেকে লেফটব্যাক ব্রাজিলের মার্সেলোর ওভারল্যাপও অলরেডের ভয়ের কারণ। যা লিভারপুলের ট্রেন্ট আলেকজান্ডার- আর্নল্ড, ফিলিপসদের রক্ষণের কাছে বড় চাপ হিসেবেই গণ্য হবে।

ইঞ্জুরির কারণে যথারীতি এবার লিভারপুলের স্কোয়াডে থাকছেন না ভার্জিল ভ্যান ডাইক, জোয়েল ম্যাতিপ ও জর্ডান হেন্ডারসন। মঙ্গলবার রাতে কেওমহিন কেলহের এবং ডিভোক অরিগির বেঞ্চে ফিরে আসতে পারেন এমন সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে মধ্যমাঠে জর্জিনিও উইনাল্ডম জেমস মিলনারের বদলে খেলতে পারেন।

সবশেষ ম্যাচে আর্সেনালের বিপক্ষে বদলি নেমে জোড়া গোল করে আলো ছড়িয়েছেন পর্তুগিজ তারকা দিয়াগো জোতা। তাই, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে আক্রমণভাগ সাজাতে মধুর সমস্যায় পড়তে পারেন কোচ জিনেদিন জিদান। যদিও শুরুতে আক্রমণভাগে মানে, সালাহ ও রবার্তো ফিরমিনো থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

• রিয়াল মাদ্রিদের সম্ভব্য একাদশঃ

কর্তোয়া; ভারানে, মিলিতাও, নাচো ; ভাস্কুয়েজ, মদ্রিচ, ক্যাসিমেরো, ক্রুস, মেন্ডি; ভিনিসিয়াস, বেনজেমা

• লিভারপুলের সম্ভব্য একাদশঃ

অ্যালিসন; আর্নোল্ড, ফিলিপস, কাবাখ, রবার্টসন; থিয়াগো, ফ্যাবিনহো, উইনাল্ডম; সালাহ,ফিরমিনো,
মানে

গত মাসে সুইজারল্যান্ডের নিওঁতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার-ফাইনাল ড্র অনুষ্ঠানে লিভারপুল বনাম রিয়াল নাম আসার পর থেকেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। প্রতিযোগিতায় সফলতম দু দলের দ্বৈরথ দেখতে মুখিয়ে আছে ফুটবলপ্রেমিরা। অলরেডরা কি এবার প্রতিশোধ নিবে নাকি ফের ইয়ুর্গেন ক্লপের দলকে কাঁদিয়ে ইউরোপ সেরার আসরে নিজেদের আভিজাত্যের জানান দিবে রিয়াল মাদ্রিদ? প্রথম লেগের উত্তর জানা যাবে আলফ্রেড ডি স্টেফানো স্টোডিয়ামে। বাংলাদেশ সময় ঠিক রাত একটায়।